আর্টিকেলটিতে যা থাকছে -
গর্ভাবস্থা যেকোনো মায়ের জন্য একটি রোমাঞ্চকর ও আনন্দের সংবাদ। গর্ভাবস্থায় নয় মাসের কঠিন যাত্রাতে গর্ভাবস্থায় মা শারীরিক সমস্যা এর সম্মুখীন হন।। গর্ভকালীন কিছু সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। যা একদম স্বাভাবিক। মা এর যদি কিছু পূর্ব ধারণা থাকে তবে মা মায়ের জন্য এ পথ পাড়ি দেওয়া সহজ হবে।
আসুন জেনে নেয়া যাক গর্ভাবস্থায় কিছু শারীরিক সমস্যা যা স্বাভাবিক ভাবে হয়ে থাকে। নিচে গর্ভাবস্থায় মায়ের কিছু সাধারণ শারীরিক সমস্যা আলোচনা করা হলো:
গর্ভাবস্থায় মায়ের কিছু সাধারণ শারীরিক সমস্যা আলোচনা করা হলো:
বুক জ্বালাপোড়াঃ
গর্ভাবস্থায় মা এর কিছু সাধারণ শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে। এজন্য গর্ভকালীন মাকে বাড়তি যত্ন নিতে হবে। এর মাঝে বুক জ্বালাপোড়া খুব স্বাভাবিক। গর্ভকালীন এসিডিটির জন্যও এ সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো রকম গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য ওষুধ খাবেন না।
- গর্ভাবস্থায় পানি বেশি পান করতে হবে।
- গর্ভাবস্থায় এই শারীরিক সমস্যা অর্থাৎ বুক জ্বালা এড়াতে ডঃ এর পরামর্শে এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ গ্রহন করতে হবে। অনেক সময় ডঃ পুরো প্রেগ্ন্যাসির সময় জুড়ে গ্যাসের মেডিসিন দিয়ে থাকে।
- বুক জ্বালা এড়াতে ফ্যাটি বা চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
- গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন সময়ে একসাথে অনেক না খেয়ে ছোট ছোট মিল বা স্ন্যাকস খাওয়া উচিত। দিনে তিন বার মেইন মিল কে ৬ বার করা উচিত অল্প অল্প করে।
- দুধ, টকদই, পুদিনা, জোয়াইন খেলে অনেকটা গ্যাস কমতে পারে।
- মায়ের শারীরিক অবস্থা এ সময় বারবার পরিবর্তন হতে পারে । তাই খাবার সাথে সাথে শুয়ে পড়া উচিত নয়।
ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ বা প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে ডিসচার্জঃ
গর্ভাবস্থায় মা এর কিছু সাধারণ শারীরিক সমস্যার মাঝে ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ অন্যতম।গর্ভাবস্থায় বেশির ভাগ নারীই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। ছত্রাক বা ফাংগাল ইনফেকশন এর জন্য এমনটা হয়ে থাকে।
- এক্ষেত্রে মা এর চুলকানি বা জ্বালাপোড়া হতে পারে। ফলে গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন যোনিপথের পিএইচ ভারসাম্যকে ব্যাহত করে ফলে ইস্ট বা ফাংগাল সংক্রমন হতে পারে। ফাংগাল ক্যান্ডিডা অ্যালবিকান (fungus candida albicans) এর সংক্রমণের জন্য এমনটা হতে পারে।
- গর্ভবতী সাদা স্রাব এর মত যেতে পারে। সার্ভিকাল মিউকাস বেড়ে যাওয়ার কারনে মা এর অস্বস্তি বোধ হতে পারে।
- প্রস্রাব নয় কিন্তু বেশ পরিমান পানি যেতে পারে।
- এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই মা কে ডঃ এর শরনাপন্ন হতে হবে।। গর্ভাবস্থায় এই সমস্যা অধিকাংশ মায়েরই হয়ে থাকে। মলম বা এন্টিবায়োটিক এর মাধ্যমে এর চিকিৎসা করতে হবে।
- ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা উচিত
- নরম সূতি আরামদায়ক আন্ডারগার্মেন্টস ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।।
কোষ্ঠকাঠিন্যঃ
গর্ভাবস্থায় মা এর শারীরিক সমস্যা যা স্বাভাবিক ভাবে হয়ে থাকে। এর মাঝে কোষ্ঠকাঠিন্য অন্যতম। দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগলে পাইলসের সমস্যা হতে পারে।
- গর্ভাবস্থায় জরায়ু বড় হতে থাকে। এটি তখন বৃহদন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তাই কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে থাকে।
- পরিপাকতন্ত্র হজমের ক্ষমতা হ্রাস পেলে মল ত্যাগ ও বায়ু নির্গমন ব্যহত হয়। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
- প্রোজেস্টেরন পরিপাকতন্ত্র এর মাংসপেশি শিথিল করে ফলে পাইলস, ফিশার, থ্রোম্বস্থ পাইলস হতে পারে। এ ছাড়াও পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্র মাংসপেশির শিথিলতা বদহজম, বমি, অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
- এজন্য ৬-৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত। অর্থাৎ দিনে দুই লিটার পানি পান করার চেষ্টা করা উচিত। তবে একসাথে অধিক পানি পান করা উচিত নয়, এতে পেটে চাপ পড়ে মায়ের কষ্ট হতে পারে
- গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা দূরীকরণে ফাইবার জাতীয় খাদ্য খাওয়া উচিত।
- বার বার অল্প করে খাওয়া উচিত
- চাপ এলে টয়লেট চেপে রাখা যাবে না
- গর্ভাবস্থায় হালকা যোগব্যায়াম করা উচিত
- ল্যাক্টুলোজ ( laxatives) গর্ভকালীন মায়েদের ব্যবহারযোগ্য ওষুধ। তারপরেও বিশেষজ্ঞ ডঃ এর পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহন করবেন।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পায়খানা নরম করার জন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।
- অনেক সময় কাপড় বরফযুক্ত পানিতে ভিজিয়ে খুব হালকাভাবে মলদ্বার এ চেপে রাখলে আরাম পাওয়া যেতে পারে।।
- আয়রন সাপ্লিমেন্ট কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারণ হতে পারে, এক্ষেত্রে আপনার গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কোষ্ঠকাঠিন্য আপনার নিয়মিত হয়ে থাকলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডঃ এর পরামর্শ নিবেন।
ক্রাম্পিং বা খিঁচ দেয়া/ খিল দেয়া/ টান খাওয়াঃ
গর্ভাবস্থায় মা এর শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে যার মাঝে ক্রাম্পিং বা খিঁচ দেয়া/ খিল দেয়া/ টান দেয়া অন্যতম। সব ধরনের ঝুঁকি এড়াতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া আবশ্যক। গর্ভাবস্থায় মা এর পায়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খিঁচ দেয়। যদি এমন হয়ে থাকে তবে মায়ের কিছু নিয়ম অনুসরণ করা উচিত।
- যদি পেশিতে টান দেয় তবে পেশিকে শিথিল করার প্রচেষ্টা করা উচিত। পায়ের আংগুল গুলো সামনের দিকে এনে স্ট্রেচিং বা শিথীল করার চেষ্টা করতে হবে।। পা কে সমান মেঝেতে রাখুন।
- পেশীকে প্রসারিত করার নিয়ম হল যদি হাঁটুর নিচে পায়ের পিছনের মাসলে টান লাগে তাহলে পা সোজা করে হাত দিয়ে পায়ের আঙুলের মাথাগুলো নিজের দিকে আস্তে আস্তে টানুন। আর যদি সামনের দিকে হয় তাহলে পা ভাঁজ করে পায়ের আঙুলের মাথাগুলো পেছনের দিকে টানুন।
- পেশীটান মুক্ত রাখতে গর্ভাবস্থায় পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত ।।
- পেশী নরম থাকলে আইস ব্যাগ বা বরফ দেয়া উচিত।
- পেশি শক্ত হলে গরম পানি বা হট ব্যাগ দেয়া যেতে পারে।
পায়ের শিরা ফুলে যাওয়াঃ
গর্ভাবস্থায় মা এর শরীরের ওজন বেড়ে যায়। তাই কিছু সাধারণ শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে ,যার ফলে মা এর অস্বস্তি লাগতে পারে। এর মাঝে পায়ের শিরা ফুলে যাওয়া গর্ভকালীন কমন সমস্যা।
- মা এর উচিত দীর্ঘ সময় দাড়িঁয়ে না থাকা। একটানা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে না থেকে সম্ভব হলে অবস্থান পরিবর্তন করা উচিত
- পা তুলে বসা উচিত
- গর্ভাবস্থায় নিচের দিকে পা ঝুঁকিয়ে বসা যাবে না
- আরামদায়ক জুতা পরুন।
- গর্ভাবস্থার শেষের দিকে পায়ে পানি আসতে পারে।
মূত্রনালীর ইনফেকশনঃ
গর্ভাবস্থায় গর্ভকালীন কিছু সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। মা এর যেসব সাধারণ শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে তার মাঝে মূত্রনালীর ইনফেকশন অন্যতম।
- বারবার প্রস্রাব পাওয়া, জ্বালাভাব, তলপেটে ব্যথা বা ক্র্যাম্প ধরা, প্রস্রাব সম্পূর্ণ না হওয়া, প্রস্রাবের পরিমাণ কম বা বেশি হওয়া, রঙ ঘোলাটে হওয়া আবার প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া এগুলো মূত্রনালীর ইনফেকশন এর লক্ষন।
- এজন্য বিশেষজ্ঞ ডঃ এর পরামর্শ নিতে হবে।
- এই সময় প্রচুর তরল ও পানি পান করতে হবে।
বমি ও বমি ভাবঃ
বমি ও বমি ভাব হওয়া গর্ভাবস্থায় খুব সাধারণ শারীরিক সমস্যা। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাস দিনের শুরুতে বেশি বমি বমি ভাব বা বমি হয়।
এক্ষেত্রে মা কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন।
- সকালে খালি পেটে পানি পানের অভ্যাস থাকলে গর্ভাবস্থায় তা ত্যাগ করতে পারেন। সকালে খালি পেটে কিছু শুকনো খাবার খেতে পারেন
- অল্প করে খাবার খাবেন। খাবার আধা ঘণ্টা পরে পানি খাবেন।
- আদা, মেন্থল জাতীয় কিছু মুখে রাখতে পারেন
- অতিরিক্ত বমি হলে বিশেষজ্ঞ গাইনীর পরামর্শ অনুযায়ী বমির ওষুধ প্রোমিথাজিন, হায়োসিন, ম্যাকলোজিন জাতীয় ওষুধ নিতে পারেন।
পিঠ ব্যাথাঃ
গর্ভাবস্থায় মা এর যেসব শারিরীক সমস্যা হয় তার মাঝে পিঠ ব্যাথা অন্যতম।। অতিরিক্ত ওজন , অস্থিসন্ধির লিগামেন্টগুলোও কিছুটা নরম ও নমনীয় হয়,এর জন্য এমন হয়ে থাকে।
- গর্ভবতী মায়ের ভারী জিনিস উঠানো উচিত নয়
- গর্ভাবস্থায় মা এর ঝুঁকে কাজ করা যাবে না।
- মেরুদণ্ড এর কিছু হাল্কা মুভমেন্ট করা। ম্যাসাজ ও করতে পারেন।
- গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন সময় ব্যাথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না।
- হট ব্যাগ সেঁক নিতে পারেন।
- ডঃ এর পরামর্শে ওষুধ নিতে পারেন। কিন্তু গর্ভাবস্থায় মা এর যেসব শারিরীক সমস্যা হয় তার মাঝে পিঠ ব্যাথা খুব স্বাভাবিক।।
ভ্যাজাইনাল এরিয়া বা যোনিপথে ব্যাথাঃ
গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। জ্বি, গর্ভাবস্থায় যোনিপথে ব্যথা হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মা এর জন্য কস্টকর এই ব্যাথা।। দীর্ঘ নয় মাসের যেকোনো সময়ে এই ব্যাথা হতে পারে
- গর্ভাবস্থায় বামপাশে শুয়ে ঘুমাবেন; রক্ত সঞ্চালন আপনাকে আরাম দিতে পারে।
- গরম পানির টাব এ বা হালকা গরম পানিতে গোসল করতে পারেন।
- কিগাল এক্সারসাইজ করতে পারেন
- বিশ্রাম নিন
- গর্ভাবস্থায় ধীরে শোওয়া-বসা করুন
- হাঁচি বা কাশির সময় সামনের দিকে ঝুঁকে কাশি দিবেন
- চিকিৎসকরা এই সময় কিছু স্ট্রেচিং এক্সারসাইজের পরামর্শ দিয়ে থাকে।
মাথা ব্যাথাঃ
গর্ভাবস্থায় মা এর শারিরীক সমস্যার মাঝে মাথা ব্যথা অন্যতম।
- মাথার দুইপাশে, চোখের পিছে বা মাথার পিছে ব্যথা হতে পারে।
- রক্ত চলাচল বেড়ে গেলে ও হরমোনজনিত কারণে মাথাব্যথা করতে পারে।
- মাইগ্রেন এর জন্য এমন হতে পারে।
- এক্ষেত্রে মা এর উচিত কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করা।
★ গরম ভাপ নেয়া
★ ঠান্ডা ভাপ নেয়া
★ ম্যাসেজ করা
★ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে বিশ্রাম নেয়া
গর্ভাবস্থায় মা এর কিছু সাধারন শারিরীক সমস্যার বিস্তারিত আলোচনা করা হল। গর্ভাবস্থায় মায়ের যেকোনো শারীরিক সমস্যায় বিশেষজ্ঞ গাইনীর পরামর্শ নেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
Disclaimer: এই প্রতিবেদনটি কেবলমাত্র সাধারণ তথ্যের জন্য, তাই বিস্তারিত জানতে হলে সর্বদা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
আরও পড়ুন:
গর্ভাবতী মা এর অধিক গরম লাগার কারন ও করনীয়
গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মা এর রোজায় করনীয়
গর্ভকালীন ডায়বেটিস এ মা এর করণীয়
গর্ভধারণে বিলম্বিত? কোন ভুল করছেন না তো?