আর্টিকেলটিতে যা থাকছে -
কিশোরী বয়সের বা টিনেজ মেয়েদের জন্য খাদ্যপুষ্টি তালিকা ও গাইডলাইন করা খুব কঠিন। কেননা সময়টি খুব সেনসিটিভ বা স্পর্শ কাতর। এই সময় টিনেজ মেয়েদের শারীরিক, মানসিক, অভ্যাসগত কিংবা আচরনগত পরিবর্তন হয়। এই বয়সই হচ্ছে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠার কিংবা ভাল অভ্যাস রপ্ত করার মূল ভিত্তি। টিনেজ মেয়েদের এই বয়সে তাদের অবস্থা থাকে এমন; যেন ওরা না তরুনী না কিশোরী। স্বভাব বশতই ওরা চায় সুন্দর ফিগার এর অধিকারী হতে। তাই এই সময়ে ওদের মাঝে দেখা যায় খাবার কন্ট্রোল করার আধিক্য কিংবা অধিক মুটিয়ে যাওয়ার প্রবনতা। তাই টিনেজ মেয়েদের প্রতি মা বাবার উচিত খাদ্যপুষ্টি ও গাইডলাইন এবং কিছু নিয়ম কানুন তৈরি করে দেওয়া। এতে তারা সহজেই বুঝতে পারবে তাদের করনীয় কি আর কি এড়িয়ে চলতে হবে। এই সময়ে খাবার তালিকার দিকে নজর দিতে হবে। খাবার তালিকার পুষ্টির অভাবে টিনেজ মেয়েটির শারীরিক দুর্বলতা, হরমোন এর সমস্যা, পিরিয়ডের সমস্যা হতে পারে। হতে পারে ভিটামিন এর অভাব কিংবা রক্তশূন্যতা।
যেহেতু এই সময়ে বেশির ভাগ সময়ই তারা থাকে বাইরে, অর্থাৎ স্কুল, কোচিং, টিউশন, আর্ট স্কুল। তাই খুব সাবধানতার সাথে তাদের খাবার তালিকা তৈরি করতে হবে।
টিনেজ মেয়েদের জন্য গাইডলাইনঃ
টিনেজ মেয়েদের জন্য গাইডলাইন এর কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় নিচে আলোচনা করা হলঃ
অভ্যাসঃ টিনেজ মেয়েদের খাদ্যপুষ্টি ও গাইডলাইন করার উপযুক্ত সময় টিনেজ।টিনেজ সময় হচ্ছে এমন সময় যখন যে বীজ বুনা হবে সেই গাছ ই মহিরুহ হবে। অর্থাৎ এই সময়ে অভ্যাস তৈরি করে দিতে হবে যা পরবর্তী জীবনে তার জীবন এর ধারা হয়ে উঠবে। সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং গাইডলাইন এর শিক্ষা যদি পরিবার থেকে পায় তবে সে আরোও উৎসাহী হয়ে পড়বে।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনঃ টিনেজ এর এই সময়টাতে খাদ্যাভ্যাস এর পরিবর্তন হয়। জাংক ফুড ভাল লাগে। যেহেতু স্কুল বা টিউশনের জন্য বাইরে থাকতে হয়। তাই ধারে কাছে যা পায় তা খেয়ে ফেলে৷ হয়তো বা বন্ধুদের চাপে পড়ে বাইরে খেতে হয়।এতে শারীরিক পরিবর্তন হয়ে যায়। স্থূলতা বৃদ্ধি পায়। যদি এই সময়ে টিনেজ সন্তান মোটা হয়ে যায় তবে জীবনের এই পর্যায়ে তার শারীরিক গঠন নিয়ে সমালোচনা না করার চেষ্টা করুন। একটি ব্যালেন্সড খাদ্যাভ্যাস সারা জীবনের জন্য রপ্ত করতে পারলে খুব উত্তম হবে আপনার টিনেজ সন্তানের এর জন্য। টিনেজ মেয়েদের খাদ্যপুষ্টি ও গাইডলাইন করার জন্য আদর্শ গাইড মা বাবা।
উৎসাহঃ টিনেজ মেয়েদের খাদ্যপুষ্টি ও গাইডলাইন করতে বা খাদ্য নির্বাচনে ওদের উৎসাহ দিন। খাদ্যাভ্যাস এর জন্য তাদের স্বাস্থ্য হয়তো একটু মোটা গড়নের, বা চিকন স্বাস্থ্যের অধিকারী। তাদের তিরস্কার না করে ব্যালেন্সড ডায়েটে উৎসাহ দিন। ধীরে ধীরে তাদের খাদ্যাভ্যাস এর প্রয়োজনীয় ব্যপারে উৎসাহ দিন। বুঝিয়ে বলুন পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা।
সহোযোগিতা ও বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাবঃ টিনেজ বয়সী একটি মেয়ের সঠিক পুষ্টিকর খাবার এর পাশাপাশি উচিত সহোযোগিতা ও বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব। কেননা এই সময়ে শারিরীক ও হরমোনের প্রভাবে পিরিয়ড অধিক আগে কিংবা দেরিতে শুরু হয়। এছাড়া হরমোনের প্রভাবে মুখে লোম গজায়, এতে চেহারার সৌন্দর্যের কারনে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এইসময়ে অনেক কিশোরীর ডায়বেটিস কিংবা থায়রয়েড ও হতে পারে, এইজন্য এইসব সমস্যা চোখে পড়লে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডঃ এর পরামর্শ নিতে হবে।
অনেক টিনেজ মেয়েদের পিসিওস এর সমস্যা থাকে। যার কারনে স্থুলতা ও শারিরীক অনেক সমস্যা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট না পাওয়ায় এবং এই বিষয় নিয়ে অবগত না থাকায় সবাই শুধু তাকে বলতে পারে মোটা কেন, খাওয়া কমাও অর্থাৎ বিভিন্ন কটুক্তি। তাই এই সময়ে সহোযোগিতা ও বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব এর পাশাপাশি কোন রোগ আছে কিনা তা নির্নয় করা উচিত। কেননা কিছু রোগের চিকিৎসা ই হলো সারাজীবন খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ।
টিনেজ বা কিশোরীর খাদ্যপুষ্টি কিভাবে বন্টন করবেন প্রস্তুত করা যায়ঃ
ক্যালসিয়ামঃ
টিনেজ মেয়েদের খাদ্যপুষ্টি এর মাঝে ক্যালসিয়াম অত্যন্ত জরুরি। এই সময় শরীর বেড়ে উঠার সময়। ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী বাচ্চাদের দৈনিক ১৩০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খাওয়ার প্রয়োজন। শরীরের হাড়, দাতঁ এর শক্তিশালী গঠনে ক্যালসিয়াম অধিক জরুরি। টিনেজ মেয়েদের ক্যালসিয়াম জরুরি কারন আজকের কিশোরী আগামীর মা। মা হওয়ার পর দুগ্ধদানে ক্যালসিয়াম এর প্রয়োজন হবে। কিন্তু হাড়ের গঠন হয়ে যায় ২১ বছর এর আগেই। এছাড়া অস্টিপোরোসিস রোগে পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি আক্রান্ত হয়। ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে নারীদের মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা হয়। তাই টিনেজ অবস্থায় তাই ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
ফ্যাটঃ
টিনেজ মেয়েদের পুষ্টির জন্য ফ্যাট বা স্নেহ পদার্থ অনেক জরুরি। কিন্তু ফ্যাট এর মাঝে ও কয়েকধরনের ফ্যাট রয়েছে। এর মাঝে কিছু ফ্যাট শরীরের জন্য দরকারী, আর কিছু ফ্যাট শরীরের জন্য ক্ষতিকর। হেলদি ফ্যাট গুলো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট নামে পরিচিত। ওমেগা থ্রি ও ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড হচ্ছে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড(PUFA) অ্যাসিড(PUFA) যা শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন।
?এগুলো বাচ্চাদের মস্তিষ্ক এর উন্নতি সাধনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
?ভাল কোলেস্টেরল উৎপন্ন করে এবং খারাপ কোলেস্টেরল কে কমিয়ে দেয় আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড
?ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড হার্ট, চোখ ও মানসিক ভারসাম্যতার জন্য অনেক উপকারী।
টিনেজ বয়সের মেয়েদের জন্য ট্রান্স ফ্যাটি এসিড খুব ক্ষতিকর। এটির কোন ভাল গুনাগুন নেই।
ট্রান্স ফ্যাট বিস্কিট, চিপস, পেস্ট্রি বা বাজারের কেক, ফ্রোজেন ফুড, সস বা জাংক ফুড। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে এসব খাবার থেকে যত দূরে থাকা যায়।
আয়রনঃ
টিনেজ এর খাদ্যপুষ্টি তালিকায় আয়রন খুব গুরত্বপূর্ণ। রক্ত প্রবাহে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য আয়রন অতি গুরুত্বপূর্ণ। আয়রনের অভাবে অ্যানিমিয়া হতে পারে। রক্ত চলাচলে যে হিমোগ্লোবিন প্রয়োজন তা তৈরি করে আয়রন। টিনেজ মেয়েরা ক্লাস, টিউশন নিয়ে সারাদিন ব্যস্ততার মাঝে কাটায়। তাই তাদের জন্য আয়রন খুব জরুরি। কেননা আয়রন এর অভাবে অবসাদগ্রস্থতা, ক্লান্তি ভাব, মাথা ব্যথা, মলিন চেহারা, ঘুমের অভাব হয়। মাংসপেশির গঠন এর জন্য আয়রন খুব প্রয়োজন। আর টিনেজ মেয়েদের পিরিয়ডের জন্য যে আয়রন নির্গমন হয়, তাই আয়রন খুব জরুরি। এই টিনেজ মেয়েদের দৈনিক ১৮ গ্রাম এর মত আয়রন প্রয়োজন। অতিরিক্ত চা কফি শরির থেকে আয়রন কমিয়ে দেয়। ভিটামিন সি গ্রহন করতে হবে কারন ভিটামিন সি আয়রন শোষনে সহায়তা করে।
জিংকঃ
টিনেজ মেয়েদের খাদ্যপুষ্টির মাঝে জিংক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সে শারীরিক বৃদ্ধির জন্য জিংক অত্যন্ত জরুরি। ইনসুলিন, গ্রোথ হরমোন এবং সেক্স হরমোন এর কাজে জিংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাড়ের বৃদ্ধি, এনজাইমের গঠন, রুচি বৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জিংকের অভাবে ডায়রিয়া বা নিউমোনিয়া হতে পারে। প্রতিদিন ১৪-১৮ মিলিগ্রাম জিংক গ্রহন করা উচিত।
প্রোটিনঃ
টিনেজ কিশোরীর খাদ্যপুষ্টি তালিকায় প্রোটিন গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেহের বৃদ্ধি, কোষ গঠন ও ক্ষয়পুরন হল প্রোটিনের প্রধান কাজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যেকের দেহের প্রতিকেজি ওজনের জন্য ০.৮ থেকে এক গ্রাম করে প্রোটিন খাওয়া প্রয়োজন। একজনের দৈনিক ক্যালরি চাহিদার ৩০ শতাংশ প্রোটিন থেকে মেটানো যায়।তবে টিনেজার দের জন্য শুধু যে প্রানীজ প্রোটিন গ্রহন করতে হবে তা নয়৷ উদ্ভিজ অনেক প্রোটিন আছে, যেগুলো খাদ্যপুষ্টি তে যোগ করে নিবেন।
কার্বঃ
টিনেজার খাদ্যপুষ্টি তে কার্ব অত্যন্ত জটিল একটি অংশ। জটিল কেন বলা হল কারন কার্বোহাইড্রেড তিন ধরনের।
?সিম্প্লেক্স -(মনোস্যাকারাইড)- গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, গ্যালাক্টোজ
?ডাবল(ডাই স্যাকারাইড) -ল্যাক্টোজ
? ৩) কমপ্লেক্স(পলিস্যাকারাইড)- সেলুলোজ, স্টার্চ
টিনেজ বয়সে তিন ধরনের কার্বই প্রয়োজন। তবে যে কার্ব গুলো সহজেই হজম বা পাচ্য হয় না তা একটু পরিমিত গ্রহন করাই ভাল। কেননা প্রচুর ক্যালরি থাকায় কার্বোহাইড্রেট ওজন বাড়ায়। শরীরে এ উপাদারটিরও প্রয়োজনীয় চাহিদা রয়েছে। তাই একটু বুঝে পরিমিত ও সঠিক কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করে সুস্থ থাকা সম্ভব।
#অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর টিনেজ এরা যদি মাংস, বা এই ধরনের প্রানীজ ও খাবার গ্রহন না করে তবে তাদের ভিটামিন বি১২৩ ও রিভোফ্লবিন এর অভাব হতে পারে৷ তাই এই ধরনের সাপ্লিমেন্ট কিংবা ওষুধ চিকিৎসক এর পরামর্শ মেনে নিতে পারেন।
করনীয়ঃ
- টিনেজের রেগুলার রুটিন যদি সুশৃঙ্খল না হয় তবে ধীরে ধীরে সময় বের করে পরিবর্তন আনুন।
- ঘুমের দিকে লক্ষ্য রাখুন। ৮-১২ ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
- কোন কারনে আপনার টিনেজ অস্বাস্থ্যকর খাবারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে তা লক্ষ্য করে পরিবর্তন করুন।
- বাইরে ঘুরাতে নিয়ে যান। যাওয়ার সময় বাস্কেট বল, স্কিপিং রোল, সাইকেল নিতে পারেন।
- ডিজিটাল যুগের এই সময়ে আপনার টিনেজ কে মোবাইল বা গেজেট থেকে দূরে রাখার চেস্টা না করে তাকে কিভাবে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত করা যায় তা ভাবুন।
- মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার এ ইউটিউব এ ভাল শিক্ষনীয় ব্যায়াম, ক্রাফটিং দেখাতে উদ্ধুদ্ধ করুন।
বর্জণীয়ঃ
১১ বছর বয়স থেকেই দিনে ৩০গ্রাম এর বেশি চিনি এবং ৬ গ্রাম এর অধিক লবন বর্জন করা উচিত। এবং ফ্যাট, আনস্যাচুরয়েড ফ্যাট, তৈলাক্ত খাবার, অধিক কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে।
এগুলো টিনেজদের নার্ভ সিস্টেম কে কিংবা শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম কে বাঁধা দেয়। টিনেজ মেয়েদের এমন ভাবে বড় করা উচিত যেন তাদের লক্ষ্য থাকে দৈনিক একঘন্টা ব্যায়াম, ইয়োগা করা।
টিপসঃ
- আপনার সন্তানকে তার খাদ্য তালিকার সমন্বয় করে দিন।
- টিনেজ কিশোরীকে তার খাদ্য তালিকা তৈরির পূর্বে তাকে এই দিকনির্দেশনার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলুন। তবে সে নিজেই আগ্রহী হয়ে উঠবে।
- ক্ষুধা লাগলেই ভারি খাবার খেতে হবে এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসুন।
- খাবারের পরিমিত ভাগ সম্পর্কে বিশদ বুঝিয়ে বলুন।
- অধিক চিনিযুক্ত খাবার কিংবা মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার কুফল বুঝিয়ে বলুন।
- টিনেজ কিশোরীকে সফট ড্রিংক্স খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কে ধারনা দিন এবং এর পরিবর্তে ঘন ঘন পানি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
- নিয়মিত শরীরচর্চা গড়ে তোলার অভ্যাস গড়ে তুলতে আপনিও যোগ দিন।
- এই সময়ে ত্বকের অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই চেষ্টা করবেন ফল, ভেজিটেবল খেতে আগ্রহী করার দিকে লক্ষ্য দেয়ার।
Disclaimer: এই প্রতিবেদনটি কেবলমাত্র সাধারণ তথ্যের জন্য, তাই বিস্তারিত জানতে হলে সর্বদা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।